হতাশায় নুয়ে পড়া শরীর। ভারতীয়দের উল্লাসের মাঝে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে মাঠ ছেড়ে যাওয়া। বেঙ্গালুরুর সেই দুঃস্বপ্নের রাত। দুই বছর পর, শেষ ওভারে দলকে জিতিয়ে, মাথার ওপর ব্যাট ঘুরিয়ে উন্মাতাল উদযাপন। প্রতিপক্ষের নাকের
ডগায় ‘নাগিন ডান্স।’ কলম্বোর টইটম্বুর গ্যালারিকে নিস্তব্ধ করে একার গর্জনে প্রকম্পিত চার পাশ। মুশফিকুর রহিমের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের কথা ভাবলেই সবার আগে উঁকি দেয় সম্ভবত এই দুটি ম্যাচের টুকরো টুকরো ছবি।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই সবচেয়ে দুঃস্বপ্নের ম্যাচ। ২০১৮ নিদাহাস ট্রফি, টি-টোয়েন্টির হতাশার প্রহরে স্মরণীয় জয়। দুটি ম্যাচেই কেন্দ্রীয় চরিত্র মুশফিক। প্রথমটিতে শেষ ওভারে দুটি বাউন্ডারিতে জয় নাগালে এনেও তিনি শেষ পর্যন্ত খলনায়ক দলকে ডুবিয়ে। পরেরটিতে অসাধারণ ব্যাটিংয়ে রেকর্ড রান তাড়ায় স্মরণীয় জয়ের নায়ক।
এমন সাফল্য-ব্যর্থতা আর উত্থান পতনে ভরা ছিল মুশফিকের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার। ১৫ বছর ২৭৭ দিনের সেই অভিযান শেষ হলো রোববার। ৩৫ বছর বয়সে তিনি বিদায় জানালেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিকে।
সাকিব আল হাসানের সঙ্গে যৌথভাবে এই সংস্করণে দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের রেকর্ড সঙ্গী করে পথচলা থামালেন মুশফিক। সাকিব রেকর্ডটাকে নিয়ে যাবেন নতুন উচ্চতায়। মুশফিকের খানিকটা আলো ফেলা যাক তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে।
নেতৃত্বের উদ্ভাসিত অভিষেক
২০১১ সালে যখন তিন সংস্করণেই বাংলাদেশের নেতৃত্ব পান মুশফিকুর রহিম, টি-টোয়েন্টিতে তখনও তিনি পায়ের নিচে জমিন খুঁজেই পাননি। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৫ ম্যাচ খেলে তখনও পর্যন্ত ২৫ ছুঁতে পারেননি একবারও। সেই তিনিই জ্বলে উঠলেন অধিনায়কত্ব পেয়ে।
২০১১ সালের অক্টোবরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে বাংলাদেশের নেতৃত্বে মুশফিকের অভিষেক। ড্যারেন স্যামির দলকে সেদিন ১৩২ রানেই আটকে রাখে বাংলাদেশের বোলাররা। সেই রান তাড়ায় ধুঁকতে থাকে বাংলাদেশ। দশম ওভারে যখন উইকেটে যান মুশফিক, দলের রান ৪ উইকেট হারিয়ে স্রেফ ৫২।
সেখান থেকেই দারুণ খেলে দলকে জয়ের কাছে নিয়ে যান মুশফিক। শেষ ওভারে ৪ উইকেট হাতে রেখে প্রয়োজন পড়ে ৬ রানের। কিন্তু রবি রামপলের করা শেষ ওভারে প্রথম ৪ বলে আসে কেবল ২ রান, এর মধ্যে আউট হন থিতু হওয়া নাসির হোসেন।
২ বলে যখন প্রয়োজন ৪ রান, দারুণ এক শটে ছক্কায় উড়িয়ে দলকে জেতান মুশফিক। শট খেলার পরই দুহাত উঁচিয়ে উল্লাস শুরু করেন তিনি, জানতেন যে ছয় হবেই! ২৬ বলে ৪১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়ে স্মরণীয় করে রাখেন নিজের নেতৃত্বের শুরুর ম্যাচ।
প্রথম ফিফটি
২০১৩ সালের নভেম্বরে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে, মিরপুরে। কলিন মানরো ও অ্যান্টন ডেভচিচের ঝড়ো দুটি ইনিংসে কিউইরা তোলে ২০৪ রান। বিশাল রান তাড়ায় বাংলাদেশ দুই উইকেট হারায় প্রথম ওভারেই। তখনই উইকেটে গিয়ে পাল্টা আক্রমণে ২৮ বলে ফিফটি করেন মুশফিক। আউট হয়ে যান অবশ্য এরপরই। তবে বাংলাদেশ সেদিন দারুণ লড়াই করে শেষ পর্যন্ত যেতে পারে ১৮৯ রান পর্যন্ত।
বেঙ্গালুরুর দুঃস্বপ্ন
স্রেফ ৬টি বল খেলেছিলেন সেদিন মুশফিক। কিন্তু সেই ইনিংসেই তার ক্যারিয়ারে লেগে যায় চিরস্থায়ী এক অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচে সেদিন ভারতের বিপক্ষে ১৪৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করছিল বাংলাদেশ। শেষ ১২ বলে যখন প্রয়োজন ১৭ রান, আট নম্বরে নামা মুশফিক প্রথম বলটি খেলেন তখন। জাসপ্রিত বুমরাহর করা ১৯তম ওভারে মুশফিক নেন তিনটি সিঙ্গেল, মাহমুদউল্লাহ তিনটি।
শেষ ওভারের সমীকরণ দাঁড়ায় ১১ রান। বোলার হার্দিক পান্ডিয়া। প্রথম বলে মাহমুদউল্লাহর সিঙ্গেল। দ্বিতীয় বলে এক্সট্রা কাভার দিয়ে মুশফিকের চার। তৃতীয় বলে স্কুপ করে আরেকটি চার মেরেই বোলার পান্ডিয়ার মুখের সামনে মুশফিকের খ্যাপাটে উদযাপন। ৩ বলে তখন আর লাগে ২ রান। জয় তো নিশ্চিত! কিন্তু ক্রিকেট খেলায় শেষের আগে শেষ নয় কিছুই। আত্মহারা উদযাপনে মুশফিক হারিয়ে ফেলেন বুঝি নিজেকে। চতুর্থ বলটি শর্ট, মুশফিক চাইলেন ‘গ্লোরি’ শট খেলতে। ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় আউট!
পরের বলে ফুল টসে ছক্কার চেষ্টায় আউট মাহমুদউল্লাহ। শেষ বলে সিঙ্গেল চুরির চেষ্টায় রান আউট মুস্তাফিজুর রহমান। অবিশ্বাস্য জয়ে বেঙ্গালুরুর ঠাসা গ্যালারিতে উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরণ। বিস্ময়ে বিমূঢ় বাংলাদেশ শিবির। আগেভাগেই উদযাপন করে ম্যাচ হারার পর সমালোচনার কেন্দ্রে মুশফিক।
কলম্বোর নায়ক
২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তখন নতুন পথের দিশা খুঁজছিল বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসানের চোটে নেতৃত্ব পাওয়া মাহমুদউল্লাহ তখন ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড’ নিয়ে বেশ সরব। সেই ব্র্যান্ডের ঝলক দেখা গেল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে।
২১৫ রানের রেকর্ড লক্ষ্য তাড়ায় বাংলাদেশকে বিস্ফোরক শুরু এনে দেন লিটন কুমার দাস ও তামিম ইকবাল। লিটন করেন ৫ ছক্কায় ১৯ বলে ৪৩। এরপর তামিম যখন ২৭ বলে ৪৭ করে বিদায় নেন, ৯.৩ ওভারে ১০০ রান হয়ে গেছে বাংলাদেশের।
তবে তখনও পথের বাকি অনেক। সেই পথেই দলকে এগিয়ে নেন মুশফিক। দারুণ ব্যাটিংয়ে শুধু দলকে পথেই রাখেননি, শেষ বৈতরণীও তিনিই পার করান। শেষ ৮ বলে যখন প্রয়োজন ১৬ রান, নুয়ান প্রদিপের বলে ছক্কায় মুশফিক সহজ করেন সমীকরণ। পরের বলে সিঙ্গেল নিয়ে ধরে রাখেন স্ট্রাইক। শেষ ওভারে ৯ রানের সমীকরণেও সব রান একাই নিয়ে দলকে জিতিয়ে দেন ২ বল বাকি থাকতে।
এরপর মেতে ওঠেন বাঁধনহারা উদযাপনে। বোলার থিসারা পেরেরার সামনে গিয়ে গর্জন, মাথার ওপর ব্যাট ঘুরিয়ে এবং ‘নাগিন ডান্স’ দিয়ে স্মরণীয় জয়ের চমকপ্রদ উৎসব। ৩৫ বলে ৭২ রানে অপরাজিত থাকেন সেদিন, তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষেও অপরাজিত থাকেন তিনি ৭২ রানেই। তবে এবার ৫৫ বল খেলে, দলকেও পারেননি জেতাতে।
দিল্লির রাজত্ব
সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের ক্রিকেট তখন হতভম্ব। দলের সবচেয়ে বড় তারকার নিষেধাজ্ঞার পর প্রথম ম্যাচ ভারতের বিপক্ষে, দিল্লিতে। বোলারদের দারুণ পারফরম্যান্সে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ আটকে গেল ১৪৮ রানে।
রান তাড়ায় বাংলাদেশের দুই ওপেনার পারেননি বড় কিছু করতে। চারে নেমে এক পাশে নির্ভরতা জুগিয়ে মুশফিক দলকে এগিয়ে নেন। সৌম্য সরকারের সঙ্গে জুটি গড়েন ৬০ রানের। এরপর মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ১৫ বলে ৪০ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দারুণ জয়!
শেষ ১০ বলে যখন প্রয়োজন ২০ রান, খলিল আহমেদের বলে টানা চার বলে বাউন্ডারি মেরে মুশফিক ম্যাচ নিয়ে আসেন মুঠোয়। বেঙ্গালুরুর সেই দুই খলনায়ক, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ এবার শেষ পর্যন্ত থেকে জিতিয়ে ফেরেন দলকে।
বেঙ্গালুরুর প্রতিশোধ কিংবা প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যই নয়, তবে ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দেওয়া হয়। ৪৩ বলে অপরাজিত ৬০ রান করে ম্যাচের সেরা মুশফিক।
ভাটার টান
দিল্লির সেই ম্যাচ জেতানো ইনিংসের পর এবারের এশিয়া কাপ পর্যন্ত ১৯ ইনিংস খেলে মুশফিকের ফিফটি স্রেফ একটি। এই সময়ে ১২ ইনিংসেই আউট হন তিনি দুই অঙ্ক ছোঁয়ার আগে! সমালোচনা বাড়ছিল। জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। অবসর দিয়েই সবকিছুর সমাপ্তি।
মলিন ক্যারিয়ার
১০২ ম্যাচ, ৯৩ ইনিংস। ঠিক ১ হাজার ৫০০ রান নিয়ে শেষ হলো মুশিফকুর রহিমের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার। ব্যাটিং গড় ১৯.৪৮। টি-টোয়েন্টিতে গড় অনেক সময়ই মূখ্য নয়, তারপরও এই গড় বেশ কম। টি-টোয়েন্টিতে বেশির ভাগ সময়ই যেটি গুরুত্বপূর্ণ, সেই স্ট্রাইক রেটও তার মোটে ১১৫.০৩।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে মোট ৪৬ জন ব্যাটসম্যান ১ হাজার ৫০০ রান করেছেন। তাদের মধ্যে গড় ও স্ট্রাইক রেট সবচেয়ে কম মুশফিকেরই! বলার অপেক্ষা রাখে না, তার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার এক কথায় হতাশাজনক।
অথচ টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের অনেক উপকরণই তার মধ্যে ছিল। তার ফিটনেস বরাবরই দুর্দান্ত, নিবেদনে ঘাটতি নেই, পরিশ্রমে কখনও তিনি পিছপা হন না। ব্যাটিং নিয়ে খাটুনিও কম করেন না। সিঙ্গেল-ডাবল বের করায় জুড়ি নেই তার। খুব পেশিবহুল না হলেও খেলতে পারেন বড় শট। বড় বড় ছক্কা তার ব্যাট থেকে এসেছে। উদ্ভাবনী শটও অনেক খেলতে পারেন।
বিপিএলে তিনি দারুণ সফল। বাংলাদেশের এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান স্কোরার তিনি, ২ হাজার ৫২৫। ব্যাটিং গড় টি-টোয়েন্টির বিবেচনায় বেশ ভালো, ৩৭.১৩। বেশির ভাগ ম্যাচ মিরপুরের মন্থর ২২ গজে খেলার পরও টুর্নামেন্টে তার স্ট্রাইক রেট ১৩৩.৪৫। সেই মুশফিক আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে মানিয়ে নিতে পারেননি সেভাবে।
কেন পারেননি, সেটা বড় রহস্য। একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হতে পারে তার ম্যাচ সচেতনতায় ঘাটতি। কখন কোন পরিস্থিতিতে কোন শট খেলতে হবে, এটায় গড়বড় করেছেন অনেক সময়। শট নির্বাচনের দুর্বলতা, আক্রমণের জন্য সঠিক বোলারকে বেছে নেওয়ায় পরিপক্কতার অভাব তার ইনিংসকে সংক্ষিপ্ত করেছে বারবার।
হাতে প্রচুর শট থাকলে সবচেয়ে জরুরি হলো নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সঠিক সময়ে উপযুক্ত শট খেলা। কিন্তু সেখানে অনেক সময়ই নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি মুশফিক। অনেক কিছু করতে গিয়ে কিছুই করা হয়নি, এমন হয়েছে অনেকবারই। স্কিলের ঘাটতি যেহেতু খুব বেশি চোখে পড়েনি কারও, মানসিকতাও নিশ্চয়ই তাকে পেছনে টেনে ধরেছে বারবার!
তবে এসব বিশ্লেষণে আপাতত শুথু মিশে থাকবে আক্ষেপই। তিনি পারেননি, আর পারার সুযোগও নেই। ১৫ বছর ধরে খেলা কারও ক্যারিয়ার শেষে মূল প্রশ্ন আসে, কী ‘লিগ্যাসি’ তিনি রেখে যাচ্ছেন। টি-টোয়েন্টির মুশফিককে নিয়ে সেটি খুঁজেও হয়রান হতে হবে। টেস্ট-ওয়ানডেতে তিনি দলের মিডল অর্ডারে সবচেয়ে বড় ভরসা, দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যান। আপাতত এই দুই সংস্করণে তার সম্ভাব্য সেরাটা পাওয়ার অপেক্ষা।